আমি ঘুড়ি সারা বাংলাদেশ!

Feb 28, 2023 - 12:11
Mar 1, 2023 - 00:40
 0  99
আমি ঘুড়ি সারা বাংলাদেশ!

গুস্তাভে ফ্লুবার্টের একটা কথা আছে, "ভ্রমণ মানুষকে পরিমিত করে তোলে। আপনি দেখতে পান যে আপনি পৃথিবীতে কত ছোট জায়গা দখল করেছেন" আসলেই রোজকার একই পরিবেশের মন যখন ক্লান্তি এবং একঘেয়েমিতে ভরে ওঠে, তখন নিত্যদিনের সেই চেনা চারপাশ থেকে আমাদের মন একটুখানি মুক্তির আনন্দের জন্য ছটফট করে। তখন মনকে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম দিতে এবং নিজের ক্লান্তি ও একঘেয়েমি দূর করতে প্রয়োজন হয় ভ্রমণের। ছোট বেলা থেকেই টুকটাক ঘোরাঘুরির চেষ্টা করেছি। স্কুলে থাকতে আমি আর চাচাতো ভাই দুইজন মিলে পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে চলে যেতাম বিভিন্ন হাওড়-বাওরে। সেখানে গিয়ে ধুমায়ে মাছ ধরে সেই মাছ নিজেরাই রান্না করে খেতাম। কাদায় মেকে নিজেকে লুটিয়ে নিতাম আর ভাবতাম একদিন এই দেশের সব হাওর-বাওর নদী নালা পাহাড়-পর্বত সুমদ্র ঘুরে দেখব। কে জানত! এই স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরা থেকেই শুরু হবে আমার ৬৪ জেলা ভ্রমন । আমার ভ্রমণের শুরুটা ছিল একটু অন্যরকম ভাবে, সময়'টা ছিল ২০১৩ সালের দিকে। স্কুল থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছিলো। বন্ধু এবং সহোপাঠী সহ আমিও যাব। তখন মনে মনে কি যে আনন্দ হচ্ছিল বলে বুঝানো যাবেনা! কিন্তু, আব্বা যেতে দিবেনা। মন খারাপ হয়ে গেল আমার। তবে স্যার আব্বাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে জোর করেই রাজি করিয়ে আমাকে নিয়ে যায় শেরপুর। আব্বা স্যারকে বড়সড় দায়িত্ব দিয়ে বসলেন। যেভাবেই হোক সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরেয়ে আনতে। স্যার একটু রিস্ক নিয়েই নিলেন তখন। এই প্রথম আমার নিজ জেলা ছেড়ে শেরপুর জেলা ভ্রমণ। নিজেকে খোঁজার এবং নতুন কিছু দেখার যাত্রা শুরু এখান থেকেই। দীর্ঘ বিরতির পর, ২০১৭ তে হাতে চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা। ইমাম ভাইয়ের সাথে সুযোগ হলো একটা প্রজেক্ট এ কাজ করার। উত্তরবঙ্গ ঘুরে ঘুরে প্রতিটা গ্রামে-গ্রামে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে রির্সাচ সার্ভে করা। রংপুরের বেশিরভাগ গ্রামে গিয়ে কাজ করা হয় অনেক দিন। বজ্রপাত আর ঝড় উপেক্ষা করেই হাওরে নৌকা নিয়ে ভেসেছি দিন রাত। তখন ঘুরাঘুরির তীব্র ইচ্ছে আরো তীব্রতর হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে স্বপ্ন দেখা শুরু করি পুরো দেশ ঘুরে দেখার। প্রতিটি জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য জানার। আশেপাশে প্রচুর মানুষের ঘোরাঘুরি দেখে অনুপ্রেরণা পাই এবং স্বপ্নের পথে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা শুরু করি। তারপর থেকে যখনি সুযোগ পেতাম নতুন কিছু দেখার জন্য তখনই ছুটে যেতাম। কিছুদিন চাকরি বা প্রজেক্ট এ কাজ করে কিছু টাকা জমা হলেই অ-দেখা কোন জেলার ইতিহাস জানতে ডুব দিতাম। বেশ কিছু দিন হিসেব করে টাকা খরচ করে চলতে হয়েছে। এর জন্য অবশ্য কৃপণ শব্দটাও শুনতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। তাতে অবশ্য খুব একটা যায় আসে নি। নিজের স্বপ্নের জন্য এগুলা কিছুই না। স্বপ্ন পূরণ নাকি লাখ টাকার সমান। পরিবার থেকে প্রথম দিকে ঘুরতে যেতে নিষেধ করলেও পরে এসে বেশ সাপোর্টই পেতাম। বাবা বরাবার ই চিন্তায় থাকতেন। বাবা কে না জানিয়ে বোনদের বলে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝেই ঘুরতে চলে যেতাম। গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত বোন রাত জেগে থাকতো। যখন পৌঁছে মেসেজ দিতাম তখন ঘুমাতো। অবশেষে প্রায় বছর পাঁচেক এর ধাক্কায় সবগুলো জেলাতে পা রাখার সুযোগ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্‌! বেশ ভালো করেই শেষ করতে পেরেছি। বরগুনা ৬৪ তম জেলা ছিল। পিরোজপুর থেকে বিষকালী নদী পার হয়ে বরগুনার বেতাগীতে ঢুকেছিলাম। বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ায় নৌকা বেশ বিপাকে। শেষ জেলা থেকে মাত্র মিনিট কয়েক দূরে এসে বিপদে পড়েও উতরে গেছি। কিছু ভাবতে পারছিলাম না। অবশেষে উত্তাল নদী পার হয়ে বেতাগী পৌঁছালাম। স্বপ্ন সত্যি হবার সাথে সাথেই কেমন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছিলো। চেষ্টা করেছি প্রতিটা জেলার ঐতিহাসিক এবং দর্শর্ণীয় সবগুলো জায়গায় যেতে। এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি। কত কিছু দেখা হয় নাই! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মত, "দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া"। বাংলাদেশের প্রতিটা গ্রামের চিত্র খুব নিখুঁত ভাবে ঘুরে দেখার ইচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত অন্য দেশকে যেভাবে উপস্থাপন করি কিন্তু নিজের দেশের কাছে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি উপস্থাপনের ঝুলি কেমন জানি ফিকে হয়ে যায়। বলছি না যে বিদেশ যাবেন না। আমারো যাবার শখ। কিন্তু নিজের দেশটা আগে অন্তত একবার দেখার চেষ্টা করুন। একবার উজাড় করে দেশকে মেলে ধরুন। কথা দিচ্ছি হতাশ হবেন না। পাহাড় আর মেঘের সাথে সখ্যতা করতে হলে আপনার বান্দরবন, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি যেতে হবে।পাহাড়ের চূড়ায় বসে নিজেকে রাজা বানিয়ে প্রাণভরে দুহাত প্রশস্ত করে নিশ্বাস নিবেন,দেখবেন তখন মনে হবে সৃষ্টির সেরা সুখি মানুষ আপনি। হাওড় দেখতে কিশোরগঞ্জ,সুনামগঞ্জ এই জেলা গুলোতে যাবেন। দেখবেন ডুবুডুবু বাড়িঘর আর জনজীবনের দৃশ্য।পাহাড়, মেঘ, হাওড়ের মিতালির প্রেমে পড়তে চাইলে ঘুরে আসুন মৌলভীবাজার। সমুদ্রের বিশালতায় ডুব দিতে চাইলে আপনার যেতে হবে কক্সবাজার । খোলা আকাশ ও বিশাল সমুদ্রের গর্জন এই দু'য়ে মিলে আপনি ভেসে যাবেন ভিন্ন এক অ-জানায়।আহা কি আছে জীবনে বলেন তো এই প্রভুর সৃষ্টির সৌন্দর্যের উপভোগ ছাড়া! বৃক্ষ আর নদীর রাজত্ব দেখতে ঘুরে আসতে হবে দক্ষিণে। ঐতিহাসিক মন্দির মসজিদ এর ছোঁয়া পাবেন রংপুর, রাজশাহীতে। খুলানার দিকে সুন্দরবন এ শ্বাসমুলের মতো ম্যানগ্রোভ বন। জীবনে সুখী হতে আর কি লাগে! কত কি দেখার আছে জানার আছে এ দেশে!লিখে শেষ করা যাবে না। আমরা প্রতিনিয়ত অন্য জেলার মানুষকে বিশ্লেষণ করি।আমার কাছে মনে হয় বিষয়টা পুরোপুরি অস্তিত্বহীন নজরদারি। আপনার চিন্তা ও ব্যবহার দিয়ে আপনি পুরো এক পৃথিবী জয়ের সক্ষমতা রাখেন। আমি আমার এই ছোট্ট ভ্রমণে কোন দিন কোথাও আঞ্চলিক ভাবে বিপদে পড়ি নাই। সব জেলার স্থানীয় মানুষজন বেশ সাহায্য করেছেন। সবাইকে শুধু আপনার সৃজনশীলতায় নিজের মত করে ভাবতে হবে। ৬৪ জেলা ঘুরা খুব কঠিন কিছু না। সবাই ঘুরে তবু আমি বলি আমি ভাগ্যবান। সুন্দর ভাবে ভ্রমণ শেষ করতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমার এই টুকটাক ঘোরাঘুরির গল্প গুলো চেষ্টা করছি রোড প্ল্যান সহ বিস্তারিত লিখতে। যদিও লেখার মত কোন প্রতিভা নেই আমার। পড়ার অযোগ্য, এলোমেলো। তবুও একটু চেষ্টা আর কি। ধীরে ধীরে সব জেলার গল্প লিখবো। আমার লেখা গুলো পাবেন https://rafanoman.blogspot.com ব্লগে-এ। আমি বার বার বলি আমার শুধু ভালো মানুষের সাথে পরিচয়। এই যাত্রা পথে যত সঙ্গী পেয়েছি, যত মানুষের সাহায্য পেয়েছি তাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিলনা । আমার কাছে "মানুষ" শব্দটাই জুইতের। আমার বন্ধু নিরঞ্জনের কবিতার লাইনগুলোর মত প্রিয়, "মানুষকে এত ক্ষুদ্রার্থে নেবেন না, মানুষ এত বড় যে, আপনি যদি ‘মানুষ’ শব্দটি একবার উচ্চারণ করেন যদি অন্তর থেকে করেন উচ্চারণ যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ‘মানুষ’ তো আপনি কাঁদবেন। হিমু পরিবহণে এসে যতগুলো মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে তাদের সংস্পর্শেই স্বপ্নটা খুব সহজেই পূরণ করতে পেরেছি। ভ্রমণ করুন, নিজেকে জানুন। দেশকে উপস্থাপন করুন। সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টিশীলতা উপভোগ করুন। আমার মনে হয়েছে একজন ভ্রমণ পিপাসু হিসেবে প্রথমত যে কোন ধরণের পরিস্থিতি মেনে নেবার মানসিকতা রাখতে হবে। এক কথায় আপনি যেখানে যেমন জীবন সেখানে কিন্তু তেমন। ভালো থাকুন। হ্যাপি ট্রাভেলিং। সবশেষে, ঘুরতে গিয়ে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না এবং স্থানীয়দের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow