আহমদ ছফার "বাঙালি মুসলমানের মন" এর পর্যালোচনা: সালেহা শামস

Mar 1, 2023 - 13:37
 0  161
আহমদ ছফার "বাঙালি মুসলমানের মন" এর পর্যালোচনা: সালেহা শামস

আহমদ ছফা তার বিখ্যাত প্রবন্ধ " বাঙালি মুসলমানের মন"(১৯৭৬) এ মুসলিম ধর্মাবলম্বী বাঙালী তথা বাংলার মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক  প্রজ্ঞার  পরিক্রম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। যুক্তিনির্ভর  এ বিশ্লেষণে তিনি বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনেতিক অবস্থানকে স্থাপন করেছেন কেন্দ্রবিন্দুতে।             

পুঁথি সাহিত্য বাঙলা ভূখণ্ডে বসবাসকারী মুসলমানের চিন্তা জগৎ ও বাস্তবতার প্রামাণ্য উদাহরণ। এই বিশাল জনগোষ্ঠী তাদের উপর আক্রমণ ও নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে বার বার ধর্মের কাছে নিরাপত্তা খুঁজেছে। এই বিশেষ শ্রেণির অতীত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তারা আবহমান কাল থেকে নির্যাতিত হয়েছে। তারা অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী। সামাজিক অবস্থানের মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটা ছাড়াই বাঙালি মুসলমানের একটি নতুন আবহে ধাবিত হয়।এই নতুন সমাজের একাংশের মধ্যে শুরু হয় চলমানতা ; যাদের আকাঙ্খা ও চাহিদা পুরনে সক্রিয় হন পুঁথিলেখনগণ।পুঁথির প্রধান বিষয়বস্তু মুলত ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য ও জৌলুশ -গাঁথা বর্ণনা করা।পুঁথিলেখকদের এবং সাধারণ মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিমন্ডলে ইসলাম সম্পর্কিত গভীর অনুধ্যান ও মৌলিক গ্রন্থসমূহের ভাষা আয়ত্ত করার মতো পর্যাপ্ত ছিলো না।যার ফলাফল দো-ভাষী পুঁথিসাহিত্যের আক্রমনাত্মক প্রতিক্রিয়াশীলতা ও সাহিত্য মানের চরম অপকর্ষ।

তাদের সামনে নিজেদের ব্যবহার-সক্ষম আদর্শ ছিলো না এবং সম্ভব ছিলো না।প্রাচীন ভারতীয় আর্য-সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি ভাষায় রচিত সাহিত্য গ্রন্থের সাহায্য লাভ করা।তারা ইসলামের মাহাত্ম্য প্রচারে বিভিন্ন ইসলামী বীরদের চরিত্র রূপায়ণ করেছে নিজের ও গোষ্ঠীর চাহিদামাফিক ; সকল ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক দিককে একপ্রকার বর্জন করেই।  রাজশক্তির আনুকূল্যে বিস্তার লাভ করা ইসলাম ধর্মে হিন্দু সমাজে কালের প্রবাহে পরিবর্তন ঘটেছে এবং এতে তারা সাড়া দিয়েছে তুলনামূলক শিক্ষিত ও পরিপক্বভাবে।ঐতিহ্য, অস্তিত্ব সমুন্নত রাখার প্রয়াশে তারা সৃষ্টি করেছে মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণবপদাবলী। হিন্দু লেখকরা জনতুষ্টিমূলক সাহিত্য রচনা করলেও তাতে নতুন সামাজিক চাহিদার জবাব আছে। এছাড়াও, হিন্দু লেখকদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আনুকুল্য ছিল, তাদের সম্পূর্ণ নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হয়নি।

তাঁরা তাঁদের প্রাচীন আদর্শ মূল্যবোধকে নতুন যুগের সাথে রূপান্তর করেছে। কিন্তু মুসলিম লেখকদের তা সম্ভব না হওয়ায় নতুন ও প্রায় অজানা বিষয়ে সাহিত্য রচনায় প্রযুক্ত হতে হয়েছে। ফলে অসংলগ্নতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে যুক্ত হয়েছে তীব্র দ্বেষ। হিন্দুদের দ্বারা চলে আসা নির্যাতনের আক্রোশ প্রযুক্ত হয়েছে তাদের দেব-দেবীর উপর।ইসলামের উদারতা-মহাত্ম্য,বীরদের অপ্রতিরোধ্য বীরত্ব প্রকাশের পাশাপাশি পুঁথি সাহিত্য হয়ে ওঠে হিন্দু ধর্ম ও তার দেব-দেবীদের অবমাননা ও বিদ্বেষ প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু দ্বেষ ও ঘৃণা করেও মুসলিমরা এর প্রভাব থেকে মুক্তি লাভ করেনি। তাই ইসলাম ধর্মের বীরদের বর্ণনায় হিন্দু মহারথীদের প্রভাব খুব স্পষ্ট হয়ে উঠে। একই সময়কালে বিভিন্ন রাজসভায় বাংলা ভাষায় পুঁথি রচিত হলেও সাধারণ জনগণের জন্য রচিত পুঁথিতে ব্যবহৃত হতে থাকে বিপুল উর্দু -ফারসি-আরবি শব্দ বহুল বাক্য।                     

ইউরোপীয় রেনেসাঁস ত্বরান্বিত করা বৈপ্লবিক ইসলামিক দর্শন কৃষ্টির সাথেও বাঙালি মুসলমানের সাক্ষাৎ হয়নি। ভারতে ইসলাম                     প্রসারে সুফীবাদের তুলনায় বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী বংশের ভূমিকা বেশি।    বর্ণবাদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষের পক্ষে জীবন দর্শন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আর্য সভ্যতার বিশ্বদৃষ্টির সাথে পরিচয় ঘটেনি অন্যদিকে ইউরোপীয় রেনেসাঁস ত্বরান্বিত করা বৈপ্লবিক ইসলামিক দর্শন কৃষ্টির সাথেও বাঙালি মুসলমানের সাক্ষাৎ হয়নি। ভারতে ইসলাম প্রসারে সুফীবাদের তুলনায় বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী বংশের ভূমিকা বেশি।সাম্রাজ্য প্রসারের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ইসলামের সাথে আরবীয় মৌলিক ইসলামের বিস্তর পার্থক্য আছে। বিভিন্ন দেশ মহাদেশে ইসলামের সাথে ছড়িয়ে পড়া জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবেশ লাভ হয়নি এ ভূখণ্ডে। ভারতবর্ষে ইসলাম কিছু বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটালেও যুক্তিবাদ,জ্ঞান,দর্শন,উদারতা প্রসারিত করতে পারেনি।

ইসলামের যুক্তিবাদ, জ্ঞানের চর্চা ভারতের অন্যান্য অংশে যৎসামান্য হলেও বাংলায় তা হয়নি। যার দায় এ অংশের মুসলিম শাসকদের উপরও বত্তায়।তারা এ অঞ্চলের শাসিত জনগণের সংস্পর্শে আসেনি,প্রশাসক হলেও এ জনগোষ্ঠীকে জীবন,মূল্যবোধের উৎকর্ষ ঘটানোর জন্য সক্রিয় হননি।তারা থেকেছেন দিল্লিমুখী।সময়ের সাথে অভ্যাসগত ও শাসকশ্রেণি ছাড়া আর কিছু পরিবর্তন হয়নি যার প্রকাশ পুঁথি সাহিত্য। পুঁথি সাহিত্য মূলত দো-ভাষী পুঁথি সাহিত্য। বাংলা পদক্রম অনুসারে রচনা করা হলেও তাতে আছে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের প্রাচুর্য। এর পেছনে এমন প্রবণতার নেপথ্যে ঐতিহাসিক কারণ আছে। ইসলামের প্রাথমিক কালে ইসলাম ও আরবীয় ভাষাকে অভিন্ন জ্ঞান করা হতো।মিশর থেকে মরক্কো সহজেই আরবি ভাষা ও বর্ণ গ্রহণ করলেও ইরান বা পারস্যে তা সম্ভব হয়নি।ইরানী জনসাধারণের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সচেতন জনগোষ্ঠী। যার ফলে নিজেদের জ্ঞানের গভীরতা ও প্রজ্ঞা আরবীয় ভাষা গ্রহণ না করেও মুসলিম হওয়ার পেছনে গ্রহনযোগ্য ও শক্তিশালী যুক্তি প্রদানে সক্ষম হয়েছে।এরপর ইরান থেকে আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে ইসলাম এবং মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইরানের ভাষা ফারসি।

ভারতবর্ষের শাসক মোঘলরা তাদের মাতৃভাষা তুর্কির বদলে ফারসিকে দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক ভাষার মর্যাদা দিলে ভারতীয় হিন্দু সমাজ জীবিকার প্রয়োজনে ফারসি ভাষা আয়ত্ত করে। কিন্তু প্রত্যাহিক জীবনযাপনে তারা ফারসিকে কখনোই গ্রহণ করেনি।ফলে ভারতে ফারসি হয়ে পড়ে জনবিচ্ছিন্ন ভাষা।ধর্মীয় উৎকর্ষ জ্ঞানে কিছু মুসলমান ফারসি বর্ণমালায় 'উর্দু ' নামে একটি কৃত্রিম ভাষা সৃষ্টি করে।সাধারণ মহলে উর্দুও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠে, যা প্রশমিত হয় স্যার সৈয়দ আহমদের 'আলীগড় ' আন্দোলনের পরে।                  

  ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিতে আন্দোলন চলাকালেও বাংলা ভাষার বিরোধিতা করা হয়েছে। বাঙালি                                         মুসলমানের  এসকল “তথাকথিত ইসলামী” ভাষার মোহ কাটতে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।   বাঙালি মুসলমানদের নিকট 'উর্দু ' ধর্মীয় ভাষার মর্যাদা পায়। পরবর্তীতে এ ভাষা রাজভাষায় পরিণত হলে মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায়। কোনো নতুন ভাষাকে রপ্ত করার আর্থিক ও সামাজিক ভিত্তি বাংলার মুসলমানদের ছিলো না। ফলে তারা উর্দু -ফারসি বর্ণতে বাংলা লেখার চেষ্টা চালায়। তখন কিছু লোক উর্দুতে জানলেও সাধারণ শ্রেণির পক্ষে তা আয়ত্ত করার সক্ষমতা ছিলো না। কিন্তু সক্ষম ও অভিজাতরা উর্দুতেই কথা বলতেন, বাংলাকে তারা নিচু ভাষা জ্ঞান করতেন। শেষ উপায় হিসেবে লেখকগণ বাংলা ভাষাতেই প্রচুর উর্দু -ফারসি শব্দ ব্যবহার শুরু করেন। সুতরাং বলা যায় বাঙালি মুসলমান লেখকেরা নিরুপায় হয়েই বাংলাতে লিখেছেন। উপায় থাকলে তারা কখনো বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করতেন না। তারা ধর্মীয় অজ্ঞতাবশত সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলাকে ঘৃণা করতেন 'হিন্দু' ভাষা বলে। যার উল্লেখ পাওয়া যায় কবি আব্দুল হাকিমের কবিতায়।

১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিতে আন্দোলন চলাকালেও বাংলা ভাষার বিরোধিতা করা হয়েছে। বাঙালি মুসলমানের এসকল “তথাকথিত ইসলামী” ভাষার মোহ কাটতে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।    বাংলার সক্রেটিস অধ্যাপক রাজ্জাকের সাথে আহমদ ছফা পলাশীর যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী জয়ী হওয়াতে উঁচু শ্রেণির মুসলিমরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। তারা সরকারি (নবাবের) চাকুরীজীবি জীবনে বাংলার সাধারণ জনগণের সাথে কোনো সম্পর্ক তৈরি করেনি ফলে কোম্পানীর নতুন নীতিতে তারা বাংলায় সংযোগ -সম্পর্কহীন বিদেশির মতো অবস্থায় পড়ে।  তারা না পারলো ইংরেজ শাসকদের সহায়তা করতে না পারলো সাধারণ মানুষকে নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু উত্তর ভারতে নিঃস্ব মুসলমানরা সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে পরিবর্তিত অবস্থার সাথে অভিযোজন ঘটানোর চেষ্টা শুরু করে। আলীগড় আন্দোলন ও আলীগড় কলেজ উত্তর ভারতীয় মুসলমানদের সাথে ব্রিটিশ শাসকদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে। তাই স্থানীয় হিন্দুদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘু হয়েও সকল দিকে তারা অগ্রগামী ছিলো।

এই আলীগড় শ্রেণি দূরবর্তী ভবিষ্যতেও আর সুযোগসন্ধানী নীতির বাইরে যেতে পারেনি।   কিন্তু একই সময়ে বাঙালি মুসলমান দিন দিন পিছিয়ে পড়তে থাকে৷ তারা আভিজাত্য হারালেও অভিজাত আদর্শে অটুট থাকে।  ইংরেজ শাসনামলে বাঙালি মুসলমানের শাসক অংশ অস্তিত্বহীন হওয়ার সাথে সামগ্রিকভাবে বাঙালি মুসলমানের দুর্দশায় তার সাথে সম্পর্কহীন।বাঙালি মুসলমান মূলত নৃতাত্ত্বিক ভাবে বাঙালি ও ধর্মীয় বিশ্বাসে বাঙালি। প্রভুত্বকারী অংশের দূর্যোগের বহুকাল পূর্ব হতেই তারা নির্যাতিত ও দুর্দশাগ্রস্ত সম্প্রদায়।সমাজে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া ও আর্থ-সমাজ,রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তাদের অংশগ্রহণ ছিলোনা কখনোই।বাংলায় আর্যবিস্তারের পর তারা জীবন বাঁচাতে বৌদ্ধ ও পরবর্তীতে একই প্রয়োজনে মুসলিম ধর্মে আশ্রয় নেয়।আর্যরা পরাজিত শক্তিকে মানুষ হিসেবে নুন্যতম সহনশীলতা প্রদর্শন করেনি।

এদেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রাচীনতম কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠোর বর্ণবাদ ; শুধু ব্রিটিশ শাসননীতিকে এর জন্য দায়ী করতে গেলে উপমহাদেশের অতীতকে কেবল দু'শ বছরের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।যা মূলত ঐতিহাসিক সত্যের অস্বীকার।     বাঙালি নির্যাতিত শ্রেণির ধর্ম পরিবর্তনের কারণ আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আত্মরক্ষা।

আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করা বাঙালি মুসলমানের শ্রেণির রাজশক্তির আনুকুল্যে সামাজিক প্রভূত্ব অর্জিত হলেও কার্যত চিন্তা-আদর্শে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি।মৌলিক উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তিত না হওয়াতে রাজশক্তি ও প্রাচীন সমাজ-সংগঠনকে মেনে নিয়েছে।ইংরেজ শাসনে বাঙালি মুসলমান নেতৃত্ব থেকে অপসারিত হলে সে স্থলে শূন্যতা পূরণ করে উচ্চবর্ণের হিন্দুর। বারবার সমাজ পরিবর্তনে ঢেউ এলেও আদিম কৃষিনির্ভর কৌম সামাজিক মানসিকতার বাঙালি মুসলমান তাতে অংশ নেয়নি।কিন্তু রাজশক্তির ধর্মে অনুসারী এবং বহুল সংখ্যক হওয়ায় তাদের একটি সামাজিক আকাঙ্খা জাগ্রত হয়।যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে পুঁথি সাহিত্যে। কেননা সাহিত্য জাতিগত আকাঙ্খার প্রথম রূপায়ক।বাঙালি কৌম সমাজ 'বাঙালি মুসলমান ' হিসেবে অনুকূল সময়ে জাগ্রত হলেও নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ।

কারণ তারা প্রাচীন সমাজ কাঠামোতে পরিবর্তন আনয়ন করতে পারেনি।স্থানীয় মুসলিম নেতৃত্বেও বাঙালি মুসলমানদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিলো না।তারা আচরণগত দিক থেকেও শাসকশ্রেণিকে অনুকরণ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।বাঙালি মুসলমানদের দুর্দশার দায় ইংরেজদের উপর চাপালে তাদের পিছিয়ে পড়ার সঠিক কারণ ব্যাখ্যা সম্ভব হবেনা।   মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজ ১৯ শতকে ইউরোপীয় জ্ঞান ও চেতনায় নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে থাকলেও মুসলমান অংশ তা থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলো।সৈয়দ আহমদ প্রমুখ মুসলিম চিন্তাবিদ মুসলিম সমাজ বলতে উঁচুতলার লোকদের মনে করতেন। বাংলাভাষাকে আশ্রয় করে স্থানীয় মুসলিমদের অধিকার চেতনা জাগ্রত হয় হিন্দুদের আন্দোলন অগ্রগতির সম্প্রসারিত রূপে। আর্থ-সামাজিক ও মূল্যবোধগত দিক থেকে হিন্দু সমাজের প্রতিযোগী হওয়ায় সমাজিক ভিত্তি তাদের ছিলো না।ধর্মীয় অচলায়তন ও সংস্কার থেকে আধুনিক জগতে হিন্দু অংশের প্রাথমিক প্রবেশ ঘটলেও মুসলমানদের সকল কার্যক্রম ছিল ধর্মীয় জাগরণের।  উত্তর প্রদেশের মত উন্নয়নের জন্য আন্দোলন পরিচালনা করার সামর্থবান মনীষী মুসলিম সমাজে জন্মায়নি এর সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের লক্ষ্যের দিকভ্রষ্টতার ফলে।      

তিতুমীর ও দুদু মিয়ার নেতৃত্বে দুটি আন্দোলনেই একমাত্র বাঙালি মুসলমান স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এ দুটি আন্দোলনে মূলত ধর্মকে চালিকা শক্তি করে বাংলার সাধারণ মানুষকে একত্র করা হয়েছে। কেননা তখনও আধুনিক রাষ্ট্র বা সামাজিক বোধে উজ্জীবিত হওয়ার পরিপক্বতা পায়নি তারা। যদিও বিস্তৃত এই আন্দোলনে উঁচু শ্রেণির মুসলমানদের সমর্থন ছিল না এবং এ সম্পর্কে আধুনিক রাষ্ট্র ও দর্শন নির্ভর আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিক দিক দিয়ে প্রগতিশীল হলেও সামাজিক দিক থেকে আন্দোলন দুটি পশ্চাৎপদ ছিলো। অন্যান্য আন্দোলনগুলো মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেওয়া নয়তো হিন্দু সমাজের উদ্যোগ ও সম্প্রসারণে।

শিল্প,সাহিত্যে, দর্শনেও তাই।কোনো শাখায় তাদের মৌলিক অবদান নেই।কতিপয় কাব্যকার সাফল্য অর্জন করলেও তাদের রচনায় মূলত চিন্তাশীলতার চেয়ে আবেগের আতিশয্য ঘটেছে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষণও করেছে হিন্দু সমাজ। বাঙালি মুসলিম লেখকগণ ধর্মীয় কল্পনার জগত ও পুরাতনের আর্চনা থেকে বের হতে পারেনি। সমাজ পরিবর্তন মূলক লেখা সৃষ্টি হয়নি তাদের দ্বারা। স্বাধীন ও নতুন চিন্তাধারে ভয় করা মুসলিম সমাজ মনে মননে অপরিণত থেকেছে গভীর জ্ঞান চিন্তাশীলতার অভাবে এবং তা ঢেকে রাখার লজ্জাজনক প্রবণতার নাম দিয়েছে 'কৃষ্টি '। উন্নত বিজ্ঞান- দর্শন সৃষ্টি বা গ্রহণ না করে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করা অসম্ভব। কিন্তু তারা এই ব্যর্থতার দায় চাপিয়েছে ' অন্য' কারো উপর। বাঙালি মুসলমানের অপরিপক্ক মননের কারণ তার বাঙালি বা মুসলমান হওয়া নয়,বরং উদার চিন্তাকে ভয় পাওয়ার  মানসিকতা।তারা চাইলে বহুকাল ধরে চলমান ঐতিহাসিক পদ্ধতি অনুসরণে সৃষ্ট এই গোলক ধাঁধা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।

অদূর ভবিষ্যতে তা সম্ভব হবে না নিশ্চয় কিন্তু বাঙালি মুসলমানের মন মানসিকতার নির্মোহ উন্মোচন ঘটানো সম্ভব হলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক, চিন্তার মুক্তি লাভ বাস্তবতা লাভ করতে পারে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow